যে মেয়েটি নিজের ভাষায় কথা বলতে চেয়েছিল

কল্পনা করুন, একজন মেয়ে যে সবসময় মনের কথা বলতে চায়, কিন্তু সমাজ তাকে চুপ করে রাখতে বলে। যে মেয়েটি ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু পায় শুধু বাঁধা নিয়ম। এই মেয়েটিই হলেন কমলা দাস – একজন কবি যিনি তার কলমের জোরে ভাঙতে চেয়েছিলেন সমাজের সব বেড়াজাল।


দুই শহরের মেয়ে

১৯৩৪ সালে জন্ম নেওয়া কমলা দাস বেড়ে উঠেছিলেন দুটি ভিন্ন জগতে। একদিকে কলকাতার ব্যস্ত শহুরে জীবন, অন্যদিকে কেরালার মালাবারের গ্রামীণ পরিবেশ। কলকাতায় তার বাবা গাড়ি বিক্রি করতেন – রোলস রয়েস আর বেন্টলির মতো দামি গাড়ি। মা বালামণি আম্মা ছিলেন একজন বিখ্যাত কবি। দাদু নালাপাট নারায়ণ মেনন ছিলেন লেখক ও অনুবাদক।

কিন্তু কলকাতার স্কুলে কমলার জীবন মোটেই সহজ ছিল না। সাদা চামড়ার ইংরেজ বাচ্চারা তাকে আর তার ভাইকে তাদের বাদামি রঙের জন্য জ্বালাতন করত। এই অভিজ্ঞতা তার মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল।

অন্যদিকে কেরালার পৈতৃক বাড়ি ‘নালাপাট হাউস’ ছিল স্বর্গের মতো। সেখানে দাদিমার স্নেহ, বড় পরিবারের উষ্ণতা আর দাদুর বিশাল লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতেই তিনি প্রথম পড়েছিলেন ওয়াল্ট হুইটম্যানের ‘লিভস অফ গ্রাস’। এখান থেকেই শুরু তার সাহিত্যপ্রেম।


পনেরো বছরের বিয়ে

মাত্র পনেরো বছর বয়সে কমলার বিয়ে হয়ে গেল। সেই যুগে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল, কিন্তু কমলার কাছে এই বিয়ে ছিল বন্দিত্বের মতো। স্বামীর কাছ থেকে যে কথোপকথন, বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা তিনি চেয়েছিলেন, তা পাননি। বরং পেয়েছিলেন শুধু শারীরিক সম্পর্কের নিষ্ঠুরতা।

এই অভিজ্ঞতা তাকে ভাবতে শিখিয়েছিল – নারীর জীবনে কি শুধুই সন্তান জন্ম দেওয়া আর স্বামীর সেবা করা? তার কি নিজের কোনো স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে না?


লেখা – মুক্তির পথ

দুঃখ আর হতাশা থেকে মুক্তি খুঁজতে গিয়ে কমলা শুরু করলেন লেখালেখি। প্রতি সপ্তাহে দুটো করে গল্প লিখতেন। স্ট্যাম্পের টাকা জোগাড় করতে স্বামীর কাছ থেকে ধার নিতেন। লেখা হয়ে উঠল তার “একমাত্র শখ” এবং “দুঃখ দূর করার উপায়”।

কিন্তু সমাজ তাকে বলল, “ইংরেজিতে লিখো না, এটা তোমার মাতৃভাষা নয়।” কমলা জবাব দিলেন দৃঢ় কণ্ঠে:

“আমাকে একা ছেড়ে দাও। আমি যে ভাষায় কথা বলি, সেই ভাষা হয়ে যায় আমার। তার বিকৃতি, অদ্ভুততা – সব আমার, কেবল আমার।”


‘মাই স্টোরি’ – যে বই ঝড় তুলেছিল

১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হল কমলার আত্মজীবনী ‘মাই স্টোরি’ (মূলত মালায়ালমে ‘এন্তে কথা’)। এই বইয়ে তিনি খুব খোলামেলাভাবে লিখেছেন তার ব্যক্তিগত জীবনের কথা – বিয়ে, যৌনতা, মানসিক যন্ত্রণা, প্রেমের খোঁজ।

সমাজে তুমুল হইচই পড়ে গেল। কেউ বললেন, “এসব কথা মেয়েরা প্রকাশ্যে বলে না।” কেউ আবার প্রশংসা করলেন তার সাহসের। কিন্তু কমলা দাস হয়ে উঠলেন ভারতীয় নারীদের কাছে এক আইকন – যিনি প্রথম সাহস করে বলেছিলেন নারীর অন্তরের কথা।


কবিতায় হৃদয়ের কথা

কমলা দাসের কবিতা পড়লে মনে হয় যেন একজন বন্ধু তার মনের কথা বলছেন। তিনি লিখেছেন:

“আমার কোনো গোপন কথা নেই। যখনই আমি কেঁদেছি, পাঠকরাও কেঁদেছেন আমার সাথে।”

তার কবিতায় উঠে এসেছে:

  • একাকীত্বের যন্ত্রণা
  • ভালোবাসার খোঁজ
  • নারী হয়ে জন্মানোর কষ্ট
  • মৃত্যুর ভয় আর পরে সেই ভয়ের জয়

একটি বিখ্যাত লাইন: “আমি সরল হতে চাই, ভালোবাসা পেতে চাই। আর যদি ভালোবাসা না পাই, তবে মরে যেতে চাই…”


সমাজের আয়নাও ছিলেন তিনি

কমলা দাস শুধু নিজের কথাই বলেননি, তুলে ধরেছেন সমাজের চিত্রও। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের দাঙ্গা, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মীয় বিদ্বেষ – এসব নিয়েও লিখেছেন। তিনি দেখেছেন কেমন করে হিংসা আর ধর্মীয় গোঁড়ামি মানুষকে পশুতে পরিণত করে।

দরিদ্র মানুষদের জন্য তার মন কাঁদত। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন এক পৃথিবীর যেখানে সবার খাবার, থাকার জায়গা আর শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।


অসুখ আর মৃত্যুর সাথে বন্ধুত্ব

জীবনের অনেকটা সময় কমলা দাস কাটিয়েছেন অসুস্থতার সাথে লড়াই করে। হৃদরোগসহ নানা অসুখ তাকে ঘিরে রেখেছিল। কিন্তু এই অভিজ্ঞতা তার লেখাকে আরও গভীর করেছে।

তিনি লিখেছেন: “অসুস্থতা হয়ে উঠেছে আমার সঙ্গী। আমি তার সাথে দীর্ঘ গোপন আলাপ করি।”

মৃত্যুভয় তিনি জয় করেছিলেন। জীবনের শেষদিকে তিনি লিখেছেন: “আমি আর মৃত্যুকে ভয় পাই না…”


রূপান্তরের গল্প

কমলা দাসের জীবন ছিল ধারাবাহিক পরিবর্তনের গল্প। তিনি নিজেকে বলতেন “অসম্পূর্ণ নারী” – যিনি লেখার মাধ্যমে নিজের জীবনকে সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করেন।

জীবনের শেষভাগে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং নাম রাখেন কমলা সুরাইয়া। এই সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছিল, কিন্তু এটাও ছিল তার আত্মিক অনুসন্ধানের একটি অংশ।


আজও প্রাসঙ্গিক কেন?

২০০৯ সালে কমলা দাস আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু তার প্রভাব আজও রয়ে গেছে। কেন?

সাহসী কণ্ঠস্বর: তিনি প্রথম বাঙালি নারী লেখক যিনি সমাজের সব নিষেধাজ্ঞা ভেঙে নিজের কথা বলেছেন।

নারীর অধিকার: আজকের যুগেও নারীরা যে সমস্যার সম্মুখীন হন – পারিবারিক চাপ, সমাজের প্রত্যাশা, স্বাধীনতার অভাব – এসব নিয়ে তিনি লিখেছেন।

ভাষার স্বাধীনতা: যে ভাষায় মন প্রকাশ পায়, সেই ভাষায় লেখার অধিকার – এই বার্তা আজও গুরুত্বপূর্ণ।

মানবিক সংবেদনশীলতা: দুঃখ, আনন্দ, প্রেম, ব্যর্থতা – জীবনের সব অনুভূতি নিয়ে তার সৎ লেখা আজও পাঠকদের ছুঁয়ে যায়।


শেষ কথা

কমলা দাস শুধু একজন কবি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন বিপ্লবী। কলমের জোরে তিনি যে বিপ্লব এনেছিলেন, তার ঢেউ আজও লাগে। তিনি দেখিয়েছেন যে সততা আর সাহস দিয়ে নিজের কথা বলা যায়, সমাজের বাঁধা নিয়ম ভাঙা যায়।

আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে কমলা দাসের বার্তা: “নিজের কণ্ঠস্বর খুঁজে নাও। যা মনে আছে, তা বলার সাহস রাখো। পৃথিবী বদলানোর ক্ষমতা তোমার ভেতরেই আছে।”

তার অমর লাইনের মতো: “আমি বেঁচে থাকব… আমার কথার মধ্যে, আমার লেখার মধ্যে, যারা আমাকে পড়বে তাদের হৃদয়ে।”


কমলা দাস (১৯৩৪-২০০৯) ছিলেন একজন ভারতীয় ইংরেজি কবি এবং মালয়ালম লেখিকা। তার আত্মজীবনী ‘মাই স্টোরি’ এবং অসংখ্য কবিতা আজও বিশ্বব্যাপী পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে।

আমি – ২০১৮ সালের একটি ভারতীয় মালয়ালাম ভাষার জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র যা কবি-লেখক কমলা দাসের জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত। এটি কমল দ্বারা রচিত ও নির্দেশিত এবং এতে মঞ্জু ওয়ারিয়ার কমলা সুরাইয়া চরিত্রে অভিনয় করেছেন, পাশাপাশি মুরলি গোপী, তোভিনো থমাস, অনুপ মেনন এবং আনন্দ বাল রয়েছেন।চলচ্চিত্রটি ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে মুক্তি পায়। এটি দুটি কেরালা রাজ্য চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেছে।

Share.

কলকাতার আপন, কলকাতার যাপন

Comments are closed.