ভাবুন তো—কোনও ভোরবেলা, ঘন কুয়াশার ভেতর থেকে হঠাৎ গর্জন শোনা যাচ্ছে। তারপর দেখা দিল এক লৌহদৈত্য, বুক ফুঁড়ে বেরোচ্ছে ধোঁয়া, শিসের সুরে কেঁপে উঠছে চারপাশ। আজকের দিনে এটি হয়তো কোনও হেরিটেজ ট্যুরের দৃশ্য, কিন্তু দুই শতাব্দী আগে এ ছিল সভ্যতার সর্বশেষ জাদু।
স্টিম লোকোমোটিভের গল্প শুরু ইউরোপে। জেমস ওয়াটের ১৭৬৯ সালের উন্নত স্টিম ইঞ্জিন না হলে এই কাহিনি সম্ভব হতো না। তবে প্রথম “লোহঘোড়া” তৈরি করেছিলেন ইংল্যান্ডের রিচার্ড ট্রেভিথিক। ১৮০৪ সালে দক্ষিণ ওয়েলসে তিনি চালালেন পৃথিবীর প্রথম চলমান স্টিম লোকোমোটিভ—“পেনি-ড্যারেন ইঞ্জিন”। তবে এটি বেশিক্ষণ টিকল না; রেললাইন ভেঙে পড়ল তার ওজনের চাপে।
সত্যিকারের বিপ্লব ঘটল জর্জ স্টিফেনসনের হাতে। ১৮১৪ সালে তাঁর তৈরি “ব্লুচার” ছিল কার্যকর প্রথম লোকোমোটিভ। আর ১৮২৫ সালে স্টকটন-ডার্লিংটন রেলপথে ছুটল “লোকোমোশন নং ১”—বিশ্বের প্রথম জনসাধারণের জন্য যাত্রীবাহী স্টিম ট্রেন। ইংল্যান্ড যেন মুহূর্তেই বদলে গেল; শিল্পবিপ্লবের হৃদস্পন্দন এবার লৌহচক্রে বাঁধা পড়ল।
ভারত তখন ঔপনিবেশিকতার আঁচলে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের লক্ষ্য ছিল—কাঁচামাল বন্দরে পৌঁছে দেওয়া আর সেনা পরিবহন। এই লক্ষ্যেই শুরু হলো ভারতের রেলপথ।
১৬ এপ্রিল, ১৮৫৩—এক ঐতিহাসিক দিন। মুম্বাইয়ের বোরিবন্দর থেকে থান পর্যন্ত ৩৪ কিলোমিটার পথে ছুটল প্রথম যাত্রীবাহী স্টিম ট্রেন। তিনটি লোকোমোটিভ—‘সাহিব’, ‘সিন্ধ’ আর ‘সুলতান’। ভারতবাসীর চোখে বিস্ময়, কানে গর্জন, আর আকাশ ঢেকে গেল ধোঁয়ায়। সংবাদপত্র লিখল—“মানুষ যেন এক দৈত্যকে দেখতে পেল, যে ঘোড়াবিহীন রথে দৌড়চ্ছে।”
এরপর একে একে বাংলায় ও দক্ষিণ ভারতে রেললাইন বসানো হলো। ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ট্রেন চালু হলো। নদীর ধারে, গ্রামের মাঠে, শহরের গলিতে তখন নতুন শব্দ ভেসে উঠল—ট্রেনের শিস। ১৮৬২ সালে মাদ্রাজ (চেন্নাই) থেকে আর্কট পর্যন্ত চালু হলো দক্ষিণ ভারতের প্রথম ট্রেন। এই পথেই ভারতজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল বাষ্পযানের সাম্রাজ্য।
স্টিম লোকোমোটিভ শুধু গতি নয়, অর্থনীতিকেও নতুন রূপ দিল। কয়লা, পাট, চা, শস্য—সবকিছু দ্রুত বন্দরে পৌঁছতে লাগল। বাংলার জুট মিল, আসামের চা-বাগান, বিহারের কয়লাখনি—সব জায়গায় স্টিম ট্রেন হয়ে উঠল প্রাণশক্তি।
অর্থনীতির পাশাপাশি সমাজও পাল্টে গেল। দূর শহর থেকে গ্রামে খবর পৌঁছল, মানুষ চলাচল করতে শিখল, দেশজুড়ে যোগাযোগের জাল গড়ে উঠল। কেউ কেউ বলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উন্মেষেও রেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল—মানুষ একে অপরের সঙ্গে দেখা করল, কথা বলল, ভাবনা ভাগ করে নিল।
ভারতে তৈরি স্টিম ইঞ্জিনের ইতিহাসও সমৃদ্ধ। ১৯৫০ সালে চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস থেকে বের হলো “শুভঙ্কর”—ভারতের প্রথম দেশীয় স্টিম ইঞ্জিন। এর পর একের পর এক শক্তিশালী মডেল এল। “WP” সিরিজের ইঞ্জিন একসময় ভারতীয় রেলের গৌরব হয়ে উঠেছিল, যার শক্তি ও সৌন্দর্য তুলনা টানা হতো ইউরোপীয় মডেলের সঙ্গে।
তবে সময় পাল্টায়। ১৯৬০-এর দশকে ডিজেল ও বৈদ্যুতিক ইঞ্জিন আসতে শুরু করল। বাষ্প ইঞ্জিনের গর্জন ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল। ১৯৯৫ সালে ভারতীয় রেল আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করল স্টিম ইঞ্জিনের অবসর।
কিন্তু ইতিহাস কি এত সহজে মুছে যায়? আজও দার্জিলিং টয় ট্রেন, কালকা-শিমলা, নীলগিরি—এসব পাহাড়ি রুটে স্টিম লোকোমোটিভ চলে, আর সেগুলো ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে সংরক্ষিত। ভারতীয় রেল মিউজিয়ামে রাখা রয়েছে প্রাচীন ইঞ্জিন, যেমন “ফেয়ারি কুইন”—১৮৫৫ সালের এক স্টিম লোকোমোটিভ, যা আজও সচল এবং বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো সচল ইঞ্জিন হিসেবে গিনেস রেকর্ডে স্থান পেয়েছে।
স্টিম ইঞ্জিন শুধু রেলপথে নয়, রূপালি পর্দায়ও তারকার মতো আলো ছড়িয়েছে। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালীতে অপু-দুর্গার চোখে প্রথম ট্রেন দেখা—এ এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ট্রেন সেখানে আধুনিকতার প্রতীক, অজানা ভবিষ্যতের ডাক।
হলিউডেও স্টিম ইঞ্জিন জনপ্রিয়। Doctor Zhivago থেকে Sherlock Holmes, এমনকি Harry Potter-এর কিংবদন্তি “Hogwarts Express”—সবখানেই স্টিম ট্রেন কাহিনিকে দিয়েছে গতি ও রোমাঞ্চ। ভারতীয় সিনেমায় মণিরত্নমের Roja কিংবা Dil Se..-তে ট্রেনের সিকোয়েন্স আজও স্মৃতিতে গেঁথে আছে।
বাংলা সাহিত্যে ট্রেন যেন এক চলমান রূপক। বিভূতিভূষণের কলমে ট্রেন মানে অচেনার ডাক, রবীন্দ্রনাথের কবিতায় ট্রেন মানে সময়ের স্রোত। প্রেমেন্দ্র মিত্র লিখেছিলেন—“ট্রেনের জানলার বাইরে যেমন দৌড়ে যায় গাছপালা, তেমনি আমাদের সময়ও দৌড়ে যায়।”
ট্রেনের শিস হয়ে উঠেছে বিদায়ের সুর, আবার প্রেমেরও প্রতীক। শৈশবের গ্রীষ্মের ছুটিতে ট্রেনযাত্রার স্মৃতি বহু প্রজন্মের হৃদয়ে রয়ে গেছে।
টাইমলাইন : ভারতীয় স্টিম ইঞ্জিনের যাত্রাপথ
- ১৮০৪ – রিচার্ড ট্রেভিথিক চালালেন বিশ্বের প্রথম স্টিম লোকোমোটিভ।
- ১৮২৫ – জর্জ স্টিফেনসনের “লোকোমোশন” জনসাধারণের যাত্রা শুরু করল।
- ১৮৫৩ – মুম্বাই–থান: ভারতের প্রথম যাত্রীবাহী ট্রেন।
- ১৮৫৪ – হাওড়া–হুগলি: বাংলার প্রথম ট্রেন।
- ১৮৬২ – মাদ্রাজ–আর্কট: দক্ষিণ ভারতের সূচনা।
- ১৯০৫ – দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে।
- ১৯৫০ – চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কসে দেশীয় ইঞ্জিন উৎপাদন।
- ১৯৯৫ – স্টিম লোকোমোটিভের আনুষ্ঠানিক অবসর।
আজকের মেট্রো রেলের যুগে স্টিম ইঞ্জিন হয়তো প্রাগৈতিহাসিক মনে হতে পারে। কিন্তু এর ধোঁয়া আমাদের কল্পনায় এখনো উড়ে বেড়ায়। কোনও গান বাজে—“চলে যাওয়া মানে নয় হারিয়ে ফেলা”—তখন মনে হয়, স্টিম লোকোমোটিভও যেন হারায়নি, শুধু রূপ বদলে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিয়েছে।
