
Photo by Myvelvettouch Official on Unsplash
“প্লেজার ওয়্যার” — অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ব্যবহৃত টয়, অন্তরঙ্গ যন্ত্র বা যৌন-সুস্থতা সামগ্রী — দীর্ঘদিন ধরে ট্যাবু থেকে ধীরে ধীরে মূলধারার ওয়েলনেস শিল্পের অংশে পরিণত হয়েছে। পশ্চিমে এটি স্বাস্থ্য ও স্ব-যত্নের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ভারতে এই পথচলা অনেক বেশি জটিল: একদিকে আছে কামসূত্রের মতো ঐতিহ্য, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক আমলের লজ্জা-শঙ্কার উত্তরাধিকার। এর সঙ্গে মিশে আছে আইনগত অস্পষ্টতা, কাস্টমসের জটিলতা, আর বাজারের দ্বন্দ্ব।
বিশ্ব ইতিহাস — প্রাচীন সমাজ থেকে আধুনিক শিল্প
- প্রাচীন সমাজ: গ্রীস, চীন, জাপানসহ নানা সভ্যতায় খননকাজে এমন বস্তু মিলেছে যেগুলো আধুনিক টয়ের মতো, যা উর্বরতা আচার ও যৌন আনন্দের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
- ১৯শ–২০শ শতক: ভিক্টোরিয়ান যুগে ইউরোপে ডাক্তাররা নারীর ‘হিস্টেরিয়া’ চিকিৎসার জন্য যান্ত্রিক ভাইব্রেটর প্রেসক্রাইব করতেন। পরে সামাজিক বিপ্লব যৌন স্বাধীনতাকে এগিয়ে দেয়।
- ২১শ শতক: আজ এটি “সেক্স টয়” থেকে “সেক্সুয়াল ওয়েলনেস” পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে। অনেক কোম্পানি এটিকে স্বাস্থ্য, মানসিক প্রশান্তি ও দাম্পত্য জীবনের উন্নতির অংশ হিসেবে বাজারজাত করছে।
ভারতীয় প্রেক্ষাপট — পরিচয় ও বাজারের বিবর্তন
ভারতে কামসূত্র বা মন্দিরের ভাস্কর্যের মতো সমৃদ্ধ ঐতিহ্য যৌন আনন্দকে একসময় স্বাভাবিকভাবে উদযাপন করেছিল। কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনে আরোপিত ভিক্টোরিয়ান নীতি যৌনতাকে লজ্জা ও নীরবতার মধ্যে ঢেকে দেয়।
- আগমন: ২০০০-এর দশকে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ও আমদানির মাধ্যমে প্রথম স্পষ্টভাবে ভারতে প্রবেশ করে। এগুলোকে সাধারণত “ম্যাসাজার” বা “পার্সোনাল ওয়েলনেস ডিভাইস” নামে বিক্রি করা হতো।
- বাজারের পরিবর্তন: ২০১০-এর পর থেকে কয়েকটি ই-কমার্স স্টার্টআপ যৌন-সুস্থতা পণ্য হিসেবে সরাসরি প্রচার শুরু করে।
- সামাজিক প্রতিক্রিয়া: নগর যুবসমাজের মধ্যে আগ্রহ বাড়লেও এখনো খোলাখুলি আলোচনা বা ক্রয় নিয়ে অস্বস্তি প্রবল।
ভারতে আইনগত বাস্তবতা
ভারতে কোনো স্পষ্ট আইন নেই যা প্লেজার ওয়্যারকে আলাদা ক্যাটেগরিতে সংজ্ঞায়িত করে। ফলে একাধিক পুরোনো আইনের অধীনে এগুলোকে অনেক সময় “অশ্লীল” বলে গণ্য করা হয়।
- অশ্লীলতার ধারা (IPC 292 ধারা): এখানে “অশ্লীল বস্তু” বিক্রি ও প্রচারকে অপরাধ বলা হয়েছে। যেহেতু প্লেজার ওয়্যারকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়নি, তাই অনেক ক্ষেত্রেই এগুলোকে অশ্লীল বলে ধরে নেওয়া হয়।
- কাস্টমস আইন: আমদানির সময় কাস্টমস প্রায়ই এগুলোকে আটকায় বা জরিমানা চাপায়।
- ই-কমার্স ফাঁকফোকর: অনলাইনে এগুলোকে “হেলথ ডিভাইস” বা “ম্যাসাজ যন্ত্র” হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়।
- আদালতের রায়: কলকাতা হাইকোর্টসহ কিছু আদালত কাস্টমসের জব্দাদেশ খারিজ করেছে, বিশেষত ব্যক্তিগত ব্যবহারের ক্ষেত্রে। তবে এখনো সুস্পষ্ট আইন প্রণীত হয়নি।
বাস্তব পরিস্থিতি — ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের জন্য
- আমদানি ঝুঁকি: বিদেশ থেকে আনা হলে কাস্টমসে জব্দ হতে পারে।
- ই-কমার্সের পথ: অধিকাংশ বিক্রেতা পণ্যের নাম পরিবর্তন করে বা স্বাস্থ্যসেবার আওতায় এনে বিক্রি করেন।
- বিজ্ঞাপন সীমাবদ্ধতা: প্রায় সব প্ল্যাটফর্মে সরাসরি বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ। তাই ব্র্যান্ডগুলো কনটেন্ট মার্কেটিং বা ওয়েলনেস-ফ্রেমিং ব্যবহার করে।
- গোপনীয়তা: ক্রেতারা গোপন প্যাকেজিং ও প্রাইভেসি নীতি গুরুত্ব দেন।
বৈশ্বিক তুলনা
যুক্তরাষ্ট্র
- ফেডারেল স্তরে সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
- কিছু অঙ্গরাজ্যে (যেমন আলাবামা, টেক্সাস) একসময় “অশ্লীল যন্ত্র” হিসেবে আইন ছিল, তবে আদালতে চ্যালেঞ্জ হয়ে সীমিত হয়েছে।
- বর্তমানে বেশিরভাগ অঙ্গরাজ্যে বৈধ, যদিও কিছু প্রস্তাবিত বিল আবার বয়স যাচাইয়ের মতো শর্ত আনতে চাইছে।
যুক্তরাজ্য
- বিক্রি ও মালিকানা বৈধ।
- তবে অফলাইন দোকান চালাতে হলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের “সেক্স শপ লাইসেন্স” প্রয়োজন।
- ই-কমার্স খোলামেলা হলেও ভোক্তা-সুরক্ষা ও বিজ্ঞাপন আইন প্রযোজ্য।
জাপান
- বিক্রি ও ব্যবহারে বৈধতা আছে এবং বাজারও বড়।
- নিয়ম হলো যথাযথ লেবেলিং ও স্থানীয় আমদানি নীতি মানা।
- সাংস্কৃতিক কারণে প্যাকেজিং প্রায়ই ইঙ্গিতপূর্ণ হলেও সরাসরি নয়।
সংক্ষিপ্ত তুলনা: উন্নত দেশগুলোতে এগুলোকে ভোক্তা-পণ্য হিসেবে দেখা হয়, যেখানে স্বাস্থ্যসুরক্ষা, বিজ্ঞাপন নীতি বা স্থানীয় লাইসেন্সিং গুরুত্বপূর্ণ। ভারতে এখনো ঔপনিবেশিক যুগের “অশ্লীলতা” ধারা আইনি জটিলতার মূল কারণ।
সাম্প্রতিক প্রবণতা
- আদালতের অবস্থান: আদালত কখনো কখনো আমদানিকারক বা বিক্রেতাদের পক্ষে রায় দিয়েছে।
- বাজারের নতুন কৌশল: কোম্পানিগুলো এখন এগুলোকে “সেক্সুয়াল ওয়েলনেস টুলস” হিসেবে ব্র্যান্ড করছে।
- আন্তর্জাতিক আলোচনার প্রভাব: যুক্তরাষ্ট্রে বয়স যাচাই বিল বা প্ল্যাটফর্মের নীতি পরিবর্তন ভারতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
পরামর্শ
ভোক্তাদের জন্য
- নির্ভরযোগ্য ও প্রাইভেসি-সচেতন বিক্রেতা বেছে নেওয়া উচিত।
- বিদেশ থেকে আনার ক্ষেত্রে কাস্টমস জব্দ হলে আইনি সহায়তা নেওয়া যেতে পারে।
ব্যবসায়ীদের জন্য
- পণ্যের নিরাপত্তা, উপাদান ও থেরাপিউটিক দিক তুলে ধরা জরুরি।
- বিজ্ঞাপনে ওয়েলনেস ফ্রেম ব্যবহার করলে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়।
নীতিনির্ধারকদের জন্য
- প্রাপ্তবয়স্ক সম্মতিপূর্ণ ব্যবহারের পণ্যকে “অশ্লীল” ধারা থেকে আলাদা করে আইন করা দরকার।
- কাস্টমস নিয়ম পরিষ্কারভাবে নির্ধারণ করলে বাজার ও ভোক্তাদের সুরক্ষা দুটোই নিশ্চিত হবে।
ভারতে প্লেজার ওয়্যার এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে যেখানে ঐতিহাসিকভাবে আনন্দ উদযাপনের ধারা আছে, কিন্তু আইন ও সমাজ এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। বিশ্বজুড়ে যেখানে এগুলো স্বাস্থ্যসুরক্ষা ও ভোক্তা অধিকারের আওতায় আসছে, সেখানে ভারতে এখনো আইনি অস্পষ্টতা ও সামাজিক কলঙ্কই বড় বাধা। ভবিষ্যতে সুস্পষ্ট আইন ও সমাজের মানসিকতা বদল এ শিল্পকে “যৌন-সুস্থতা”র স্বীকৃতি দিতে পারে।
