কলকাতাকে আমরা আজও বলি “প্রাণের শহর”। রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র, নজরুল, সত্যজিৎ—অসংখ্য গুণীজনের অবদানে এই শহর এক অনন্য জায়গা দখল করেছে। কিন্তু এই প্রাণময় শহরের এক গোপন কোণায় লুকিয়ে আছে এক বিস্মৃত অধ্যায়—কলকাতার বাবু সংস্কৃতি। এক সময় এই সংস্কৃতি মানেই ছিল প্রাচুর্য, বিলাসিতা, শৌখিনতা আর একইসাথে সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র।
উদ্ভব: নবধনী শ্রেণির উত্থান
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ শুধু বাংলার রাজনৈতিক ভাগ্যই বদলায়নি, গড়ে তুলেছিল এক নতুন সামাজিক শ্রেণি—‘বাবু’। রবার্ট ক্লাইভ যখন কলকাতাকে নতুন করে সাজাচ্ছেন, তখন ইংরেজদের দেওয়ান, মুন্সী, তহবিলদার কিংবা বেনিয়ান হয়ে রাতারাতি ধনী হলেন কিছু বাঙালি। ইংরেজরা তাঁদের বলতে শুরু করল ‘বাবু’।
কথাটা আজ আমাদের কাছে একটু খোশগল্পের মতো শোনালেও, তখন এই উপাধিই ছিল ধন-সম্পদ আর ক্ষমতার প্রতীক। রাজা নবকৃষ্ণ দেব—যিনি ক্লাইভের অনুকূলে ‘রাজা’ উপাধি পান—ছিলেন এই বাবু সংস্কৃতির পথিকৃত। দুর্গাপূজাকে তিনি করেছিলেন এক সামাজিক উৎসব, বিপুল অর্থে ঝলমলে এক প্রদর্শনী।
বিকাশ: বিলাসিতা, শৌখিনতা আর অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা
উনিশ শতকের প্রথম থেকে মধ্যভাগ—এটাই ছিল বাবু সংস্কৃতির সোনালি সময়। তাদের জীবনযাপন একদিকে যেমন লন্ডনের রাজপ্রাসাদের অনুকরণে অট্টালিকা, গ্রিক মূর্তি আর ইউরোপীয় আসবাবপত্রে ভরপুর ছিল, অন্যদিকে তেমনই কানে ধরিয়ে দেওয়া কীর্তিতে ভরা।
- অদ্ভুত শখ:
- ভুবনমোহন নিয়োগী পোড়া টাকার নোট দিয়ে চুরুট ধরাতেন।
- প্রদ্যুম্ন মল্লিকের গাড়ি টানত ঘোড়া নয়, জেব্রা।
- কেউ কেউ এক লাখ টাকা খরচ করে বিড়ালের বিয়ে দিতেন।
- কানাই মল্লিক ঘুড়ির সুতোয় পাঁচ ও দশ টাকার নোট বেঁধে ওড়াতেন আকাশে।
- অমিতব্যয়ী আয়োজন:
- রাজা নবকৃষ্ণ দেব মায়ের শ্রাদ্ধে খরচ করেছিলেন প্রায় ৯ লাখ টাকা।
- গোপীমোহন দেব স্ত্রীর শ্রাদ্ধে ১০,০০০ লোককে খাইয়েছিলেন।
- কৃষ্ণরাম বসু বিসর্জনের সময় গঙ্গার পথে মহিলাদের হাতে কলসির সঙ্গে টাকা দিতেন—খরচ হত হাজার হাজার টাকা।
- রক্ষিতা ও বাঈজি সংস্কৃতি: দিনের আলোয় ঘরে, রাতের আঁধারে রক্ষিতার দালানকোঠায়। জাতপাত নির্বিশেষে রক্ষিতা রাখার চল এতটাই স্বাভাবিক ছিল যে অনেকে তাঁদের জন্য আলাদা বাড়ি বানিয়ে দিতেন।
সমালোচনা: ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ আর সাহিত্য
এই বিলাসবহুল অথচ অবক্ষয়িত জীবনযাপন অবশ্য সবার নজর এড়ায়নি।
- বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, পুরুষরা বাইরে রক্ষিতার ঘরে রাত কাটালেও সমাজে তাদের দোষ হত না, অথচ একজন নারী সতীত্বে সামান্য বিচ্যুত হলেও কলঙ্কিত হতেন।
- কালীপ্রসন্ন সিংহ তাঁর হুতোম প্যাঁচার নকশা-য় বাবুদের দেখিয়েছিলেন “অলস কর্মবিমুখ হিংসুটে নিন্দুক ফিচেল” হিসেবে।
- ‘বাবু ইংলিশ’ নামের এক বিচিত্র ভাষাও তৈরি হয়েছিল—বাংলা-ইংরেজি মিশ্রণে লেখা চিঠি, যা লর্ড কার্জন পর্যন্ত সংগ্রহ করেছিলেন বিনোদনের জন্য।
পতন: বিলাস থেকে বিস্মৃতিতে
বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই বাবু সংস্কৃতি ভেঙে পড়ল।
- রাজনৈতিক পরিবর্তন: রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তর, বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ার, কলকাতার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া।
- অর্থনৈতিক সংকট: বিশাল অট্টালিকার রক্ষণাবেক্ষণ, শরিকী মামলা আর অমিতব্যয়ী খরচে সর্বস্বান্ত হওয়া।
- নতুন সমাজের উত্থান: পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মার্জিত মধ্যবিত্ত সমাজ বাবু সংস্কৃতির জায়গা দখল করল।
