উনিশ শতকের কলকাতায় অপরাধ, রহস্য আর কুসংস্কারের জাল ছড়িয়ে ছিল সমাজজীবনের অন্দরে। প্রতিদিন কোথাও ঘটছে অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড, কোথাও আবার অলৌকিক কাণ্ডকারখানার আড়ালে লুকিয়ে আছে মানুষের কুকীর্তি। সেই সময় কলকাতা পুলিশের দারোগা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। কাজ ছিল মামলার তদন্ত করা, অপরাধীদের জেরা করা, সাক্ষ্যপ্রমাণের খোঁজ পাওয়া। কিন্তু কর্তব্য পালনের পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করেছিলেন—এই বিচিত্র কাহিনিগুলো যদি খাতায় না থেকে সাহিত্যের পাতায় আসে, তবে পাঠকেরা কেবল রোমাঞ্চই পাবেন না, চিনতে পারবেন সমাজের এক বাস্তব মুখও।
সেই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নিল তাঁর অমর সৃষ্টি—“দারোগার দফতর”।
১৮৮৯ সালে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হতে শুরু করে এই গ্রন্থ। প্রতিটি গল্প যেন পুলিশের ডায়েরি থেকে উঠে আসা জীবন্ত কেস, যেখানে রয়েছে রহস্য, রোমাঞ্চ এবং মানুষের মনস্তত্ত্বের টানাপোড়েন। “বিষকুম্ভ”-এ আমরা দেখি প্রতিশোধ আর গ্রামীণ কুসংস্কারের ভয়াবহ চেহারা, “মোহিনী”-তে উঠে আসে প্রেম-প্রতারণা আর অন্ধবিশ্বাসের নাটকীয় পরিণতি, আর “ভূতের গল্প”-এ তথাকথিত অলৌকিক আতঙ্কের আড়ালে ধরা পড়ে মানবিক ষড়যন্ত্র।
এসব কাহিনি পাঠককে যেমন ভয়ের শিহরণ দিয়েছে, তেমনই দেখিয়েছে—অপরাধ আর অন্ধবিশ্বাস কীভাবে সমাজকে গ্রাস করে ফেলে। তাই প্রিয়নাথ দারোগাকে কেবল বিনোদনের লেখক নয়, বরং বাংলা অপরাধ-সাহিত্যের অগ্রদূত হিসেবেই গণ্য করা হয়। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা বা শরদিন্দুর ব্যোমকেশের অনেক আগে তিনি এই ধারার বীজ বপন করেছিলেন। তাঁর গল্পগুলো একদিকে অপরাধের ইতিহাস, অন্যদিকে উনিশ শতকের কলকাতার সমাজের দলিল—যেখানে মিশে আছে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, দারিদ্র্য, লোভ আর ভয়। আর সব কিছুর উপরে, তিনি পুলিশি খাতার শুষ্কতাকে ভেঙে এমন আখ্যানরীতি তৈরি করেছিলেন, যা সাধারণ পাঠকের কাছেও হয়ে উঠেছিল উপভোগ্য।
আজকের ডিজিটাল যুগে প্রিয়নাথ দারোগার সেই আখ্যানকে আবার নতুনভাবে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। খুব শিগগিরই মুক্তি পাচ্ছে একটি পডকাস্ট শর্ট সিরিজ, যেখানে দারোগা প্রিয়নাথের চরিত্রে কণ্ঠ দেবেন জনপ্রিয় অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী। অডিও ড্রামার এই নতুন রূপে “দারোগার দফতর”-এর কাহিনিগুলো আবার শোনা যাবে রহস্য, উত্তেজনা আর অভিনয়ের আবহে। একশো বছরেরও বেশি পুরোনো অপরাধকাহিনি যখন আধুনিক মাধ্যমের ছোঁয়ায় ফিরে আসবে, তখনই বোঝা যাবে—কেন প্রিয়নাথ দারোগার লেখা আজও আমাদের সময়ের জন্য প্রাসঙ্গিক।
