Photo by Zach Camp on Unsplash
ভারতের আধুনিক কর্মসংস্কৃতিতে আমরা প্রায়ই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ দেখি—যাঁরা রাতদিন খেটে সাফল্যের শিখরে পৌঁছাতে চান। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আত্মকেন্দ্রিকতা এক জিনিস নয়। কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা তাঁদের কর্মজীবনকে শুধু অগ্রগতির জন্য নয়, বরং নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার এক মঞ্চে রূপান্তরিত করেন। এদেরই বলা যায় পেশাগত নার্সিসিস্ট (Professional Narcissist)।
এটি কোনও আনুষ্ঠানিক মনোবৈজ্ঞানিক পরিভাষা নয়, বরং কর্মক্ষেত্রের এক বাস্তব আচরণধারা। যাঁরা নিজেদের সাফল্য ও স্বীকৃতির জন্য চারপাশের মানুষ, সহকর্মী কিংবা সংস্থার সামগ্রিক স্বার্থকে উপেক্ষা করেন, তাঁরাই পেশাগত নার্সিসিস্ট।
পেশাগত নার্সিসিস্ট কে?
পেশাগত নার্সিসিস্টকে চেনার জন্য কয়েকটি মূল বৈশিষ্ট্য দেখা যায়—
- কাজের সঙ্গে আত্মপরিচয় বাঁধা: তাঁদের জীবনের প্রধান পরিচয় হলো পদবি, বেতন, ও সামাজিক মর্যাদা। অফিসের বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে তাঁরা প্রায় শূন্যতা অনুভব করেন।
- চরম স্বীকৃতির তৃষ্ণা: পদোন্নতি, পুরস্কার বা বসের প্রশংসা ছাড়া তাঁদের আত্মসম্মান টিকেই না। অন্য কেউ কৃতিত্ব পেলে তাঁরা আড়ালে আক্রোশ প্রকাশ করেন।
- অতিরিক্ত প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব: সহকর্মী তাঁদের কাছে টিমমেট নয়, প্রতিদ্বন্দ্বী। জয়-পরাজয় মানসিকতায় কাজ করেন।
- চাতুর্যের আড়ালে স্বার্থ: প্রথম দেখায় তাঁরা আকর্ষণীয়, কথা বলায় পারদর্শী। কিন্তু এই সৌজন্য আসলে স্বার্থ উদ্ধার করার কৌশল।
- সহানুভূতির অভাব: টিমের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর নেই। অন্যের অবদানকে ছোট করা বা নিজের নামে কৃতিত্ব নেওয়া তাঁদের স্বভাব।
- ভঙ্গুর অহংকার: বাইরে থেকে আত্মবিশ্বাসী মনে হলেও সমালোচনায় ভেঙে পড়েন। কেউ তাঁদের দক্ষতা প্রশ্ন করলে তাঁরা আক্রমণাত্মক বা প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারেন।
ভারতীয় কর্মসংস্কৃতিতে প্রেক্ষাপট
ভারতের অফিস সংস্কৃতি বহুলাংশে হায়ারার্কিক্যাল (hierarchical) বা স্তরভিত্তিক। বস মানেই অনেক সময় অচল সত্য। এই কাঠামোতে পেশাগত নার্সিসিস্টরা খুব সহজেই জায়গা করে নেন।
- গুরুজন সংস্কৃতি: ভারতীয় সমাজে সিনিয়রদের প্রতি অগাধ সম্মান দেখানোর রীতি আছে। ফলে, একজন নার্সিসিস্ট ম্যানেজার সহজেই জুনিয়রদের নীরব করিয়ে দিতে পারেন।
- ‘চাকরি বাঁচাও’ মানসিকতা: অনেক কর্মী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন—চাকরি হারানোর ভয়ে তাঁরা প্রতিবাদ করেন না। এই সুযোগে নার্সিসিস্ট বস বা সহকর্মী তাঁদের প্রভাব বিস্তার করেন।
- সামাজিক মর্যাদার মোহ: বেতন, গাড়ি, পদবি—এই সবকিছু ভারতে সামাজিক মর্যাদার সঙ্গে জড়িত। ফলে পেশাগত নার্সিসিস্টরা এ জিনিসগুলো দেখিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করতে ভালবাসেন।
- গ্রুপিজম বা লবি কালচার: অফিসে প্রায়শই দেখা যায়, নার্সিসিস্টরা ছোট ছোট গোষ্ঠী তৈরি করে নিজেদের সমর্থনশক্তি বাড়ান। এর ফলে দক্ষ কর্মী অনেক সময় পিছিয়ে পড়েন।
উদাহরণ
ধরা যাক, এক বহুজাতিক কোম্পানির প্রোজেক্ট ম্যানেজার প্রতিটি প্রেজেন্টেশনে দাবি করেন, “এই আইডিয়া আমার”। অথচ বাস্তবে আইডিয়াটি টিমের এক জুনিয়রের। ম্যানেজার পুরস্কার পেলেও জুনিয়র চুপ করে যান, কারণ প্রতিবাদ করলে ভবিষ্যতের সুযোগ নষ্ট হতে পারে। এই পরিস্থিতি ভারতের অসংখ্য অফিসে প্রতিদিন ঘটে চলেছে।
এর প্রভাব
পেশাগত নার্সিসিস্টরা শুধু নিজেদের ক্ষতি করেন না, বরং পুরো সংস্থার জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠেন।
- টিম স্পিরিট নষ্ট হয়: সহযোগিতার বদলে প্রতিযোগিতা বাড়ে।
- ট্যালেন্ট ড্রেন: দক্ষ কর্মীরা হতাশ হয়ে চাকরি ছেড়ে দেন।
- সৃজনশীলতার ঘাটতি: সবাই ভয়ে সৃজনশীল আইডিয়া শেয়ার করতে চান না।
- অফিস পলিটিক্স বৃদ্ধি: অফিসে কাজের থেকে রাজনীতি বেশি গুরুত্ব পায়।
ভারতীয় প্রেক্ষাপটে সাধারণ রূপ
ভারতের কর্পোরেট, সরকারি অফিস, এমনকি স্টার্টআপ কালচারেও পেশাগত নার্সিসিস্টদের দেখা মেলে।
- কর্পোরেট সেক্টর: এখানে তাঁরা নিজেদেরকে “রকস্টার কর্মী” হিসেবে প্রচার করেন, যাঁদের ছাড়া কোম্পানি চলবে না।
- সরকারি চাকরি: ক্ষমতা আর পদমর্যাদা ব্যবহার করে তাঁরা জুনিয়রদের প্রভাবিত করেন।
- স্টার্টআপ সংস্কৃতি: এখানে তাঁরা নিজেদের “ভিশনারি” ভাবতে ভালোবাসেন, এবং সমালোচনা একেবারেই সহ্য করতে পারেন না।
কীভাবে মোকাবিলা করবেন?
১. ব্যক্তি স্তরে
- নিজেকে সুরক্ষিত রাখুন: তাঁদের সঙ্গে কাজের সময় ডকুমেন্টেশন রাখুন—কে কী অবদান রাখল তা লিখিত প্রমাণ রাখুন।
- অতিরিক্ত আবেগে জড়াবেন না: তাঁদের সমালোচনায় মানসিকভাবে ভেঙে পড়বেন না।
- সীমা নির্ধারণ করুন: স্পষ্ট করে জানান, আপনি কতটা কাজ করবেন এবং কতটা দায়িত্ব নেবেন।
২. টিম স্তরে
- স্বচ্ছতা বজায় রাখুন: কাজের রিপোর্ট, ইমেল, মিটিং নোটস—সব কিছু টিম-শেয়ারড প্ল্যাটফর্মে রাখুন।
- সম্মিলিত স্বীকৃতি: টিমের কৃতিত্বকে সবাই মিলে উদযাপন করুন, যাতে একক ব্যক্তি কৃতিত্ব নিতে না পারেন।
৩. প্রতিষ্ঠান স্তরে
- ৩৬০ ডিগ্রি ফিডব্যাক: শুধু বস নয়, সহকর্মী ও জুনিয়রদের ফিডব্যাককেও গুরুত্ব দিন।
- নিয়মিত এইচআর প্রশিক্ষণ: ম্যানেজারদের জন্য ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স (EI) ও সহানুভূতি শেখানো জরুরি।
- অভিযোগের নিরাপদ চ্যানেল: কর্মীরা যাতে ভয় ছাড়াই সমস্যার কথা জানাতে পারেন, এমন সিস্টেম গড়ে তোলা দরকার।
সমাধানের পথ
ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে পেশাগত নার্সিসিস্টদের প্রভাব কমাতে হলে একটি সংস্কৃতি পরিবর্তন দরকার। শুধু ব্যক্তিগত সাফল্য নয়, সহযোগিতা, টিমওয়ার্ক ও সহানুভূতির মূল্যায়ন করতে হবে।
- স্কুল-কলেজ থেকেই নেতৃত্ব মানে শুধুই ‘আমি শ্রেষ্ঠ’ নয়, বরং ‘আমরা একসাথে এগোব’—এই পাঠ দিতে হবে।
- সংস্থাগুলোকে শুধু প্রোডাক্টিভিটি নয়, বরং সুস্থ কর্মপরিবেশকে কেপিআই হিসেবে ধরতে হবে।
পেশাগত নার্সিসিস্টরা আমাদের সমাজের এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা। তাঁরা দেখতে ঝকঝকে, কিন্তু ভেতরে ভঙ্গুর। ভারতীয় কর্মক্ষেত্রে তাঁদের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। তবে সচেতনতা, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের মাধ্যমে এই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
অবশেষে, সাফল্যের আসল মানে শুধু পদোন্নতি বা বেতন নয়—বরং এমন এক পরিবেশ তৈরি করা যেখানে সবাই সমানভাবে বেড়ে উঠতে পারে। আর সেই পথেই ভারতীয় কর্মসংস্কৃতির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হতে পারে।
